back to top
শনিবার, মে ৩১, ২০২৫
HomeBusinessInnovationঢাকা শহরের রাস্তায় আসছে বুয়েটের নতুন নিরাপদ রিকশা

ঢাকা শহরের রাস্তায় আসছে বুয়েটের নতুন নিরাপদ রিকশা

একসময় ঢাকার অলিগলিতে ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার গতিতে টুংটাং আওয়াজ তুলে ছুটত পায়ে চালিত রিকশা। শহরের পরিচিত ছন্দের অংশ ছিল এগুলো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে শহরের গতিও বেড়েছে, বেড়েছে যানজট, কমেছে নিরাপত্তা। এরপর এলো ব্যাটারিচালিত রিকশার ঢল—অনিয়ন্ত্রিত, নিবন্ধনহীন, অনিরাপদ।

এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই এক নতুন আশার আলো দেখিয়েছে বাংলাদেশের গর্ব, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। তাদের যন্ত্রকৌশল বিভাগের একদল মেধাবী গবেষক তৈরি করেছেন নতুন প্রজন্মের এক নিরাপদ রিকশার নকশা—যা শুধু টেকসই নয়, একইসাথে সাশ্রয়ীও।

দুই বছরের গবেষণার ফল: রিকশার আধুনিকায়ন

২০২২ সাল থেকে অধ্যাপক মো. এহসান ও তাঁর ছয় সদস্যের দল অক্লান্ত পরিশ্রম করে গড়ে তুলেছেন এই নতুন রিকশার নকশা। এতদিন সিটি করপোরেশন বা সরকারের কাছে সাড়া না পেলেও অধ্যাপক এহসান হাল ছাড়েননি। শেষ পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ঘোষণা করেছে—ঢাকার রাস্তায় এই নতুন নকশার রিকশা চলবে, আর ধীরে ধীরে পুরোনো, ঝুঁকিপূর্ণ রিকশাগুলো সরিয়ে নেওয়া হবে।

এ যেন রাস্তায় চলা লাখ লাখ যাত্রী আর চালকদের জন্য নতুন নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি!

কী থাকছে বুয়েটের নতুন রিকশায়?

নতুন এই রিকশার আকার হবে এখনকার রিকশার মতোই—দৈর্ঘ্য ৩.২ মিটার, প্রস্থ ১.৫ মিটার এবং উচ্চতা ২.১ মিটার। তবে ভেতরের নির্মাণ এবং প্রযুক্তিতে এসেছে বড় পরিবর্তন।

উন্নত ব্রেকিং ব্যবস্থা

তিনটি চাকার প্রতিটিতে থাকছে হাইড্রোলিক ডিস্ক ব্রেক, সাথে বিকল্প পার্কিং ব্রেকও। এর মানে হলো, হঠাৎ থামতে হলেও রিকশা সহজে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে—কোনো ঝুঁকি ছাড়াই।

লুকিং গ্লাস ও ইন্ডিকেটর

রিকশার পিছনের যানবাহন দেখার জন্য থাকবে মিরর, আর মোড় নেওয়ার সময় ইন্ডিকেটর সিগনাল—যা সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে বড় ভূমিকা রাখবে।

ছাউনির সুবিধা

নতুন রিকশায় থাকবে ছাউনি ও কাচের উইন্ডশিল্ড। বৃষ্টি হোক বা কড়া রোদ—চালক এবং যাত্রী উভয়ের জন্য আরামদায়ক যাত্রা নিশ্চিত হবে।

উন্নত হেডলাইট

হেডলাইটে থাকবে হাই বিম, লো বিম এবং ডে-টাইম রানিং ল্যাম্প (DRL)—রাতে অথবা খারাপ আবহাওয়াতেও সড়ক পরিষ্কার দেখা যাবে।

এক কথায়, রিকশাটিকে নিরাপত্তা আর আরামের এক নতুন সংজ্ঞায় নিয়ে গেছে বুয়েট টিমের উদ্ভাবন।

খরচ কেমন?

সবচেয়ে বড় সুখবর—নতুন এই নিরাপদ রিকশার দাম হবে বর্তমান ব্যাটারিচালিত রিকশার সমান, প্রায় ১.৫ লাখ টাকা!
এর মধ্যে ব্যাটারির জন্য লাগবে ৫০-৬০ হাজার টাকা আর বাকি অংশ কাঠামোর খরচ। ব্যাটারিগুলো ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলবে একবার চার্জে এবং দেড় বছর অন্তর পরিবর্তন লাগবে। পুরনো ব্যাটারিগুলোও রিসাইকেল করা যাবে, যা পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

গতি কত?

নতুন রিকশার সর্বোচ্চ গতি হবে ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার। শুনতে হয়তো দ্রুত মনে হতে পারে, কিন্তু তিনটি চাকায় হাইড্রোলিক ব্রেক থাকায় এই গতি সম্পূর্ণ নিরাপদ বলে জানাচ্ছেন অধ্যাপক এহসান।

এখনকার ব্যাটারিচালিত রিকশার মতো ভয়ংকর দৌড় নয়—বরং পরিকল্পিত, নিয়ন্ত্রিত চলাচল হবে শহরের ব্যস্ত রাস্তায়।

কেন এই উদ্ভাবন এত জরুরি?

ঢাকায় বর্তমানে নিবন্ধনহীন এবং অনিয়ন্ত্রিত ব্যাটারিচালিত রিকশা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। নেই চালকদের প্রশিক্ষণ, নেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ফলে প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা।

বুয়েটের নতুন নকশা কেবল রিকশাকে আরও নিরাপদ করছে না, বরং চালক, যাত্রী এবং সামগ্রিকভাবে শহরের পরিবহন ব্যবস্থায় এক ইতিবাচক পরিবর্তনের বার্তা দিচ্ছে।

ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে নিরাপদ, টেকসই, পরিবেশবান্ধব রিকশা বাস্তবায়ন শুধু শহরের চেহারা বদলাবে না, বরং জীবন বাঁচাবে।

সামনে কী আসছে?

ডিএনসিসি জানিয়েছে, নতুন রিকশা চালুর প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে চলছে। পুরোনো রিকশাগুলো ধীরে ধীরে সরিয়ে দেওয়া হবে। এটি একটি নীরব বিপ্লব—যেখানে প্রযুক্তি, স্থায়ী সমাধান, এবং মানুষের জীবনমান উন্নয়ন একসাথে কাজ করছে।

ঢাকা শহরের রাস্তায় যখন এই নতুন প্রজন্মের রিকশাগুলো ছুটবে, তখন শুধু যানবাহনের পরিবর্তন নয়—শহরের চিন্তাভাবনাতেও আসবে বড় পরিবর্তন।

বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠান যখন গবেষণা দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের জীবন বদলাতে ভূমিকা রাখে, তখন গর্বে বুক ভরে আসে। এবার সময় এসেছে, প্রযুক্তি এবং নিরাপত্তার এমন যুগান্তকারী উদ্ভাবনকে স্বাগত জানানোর।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular