“জীবনে কেউ যদি বলে, তুই কিছুই হতে পারবি না—তাকে প্রমাণ করে দেখিও যে, তুমি সব হতে পারো।”
এই কথাটা বলেছিলেন একজন তরুণ, যিনি কখনো প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে দিন কাটাতেন, আবার কখনো রাস্তায় জুতা পালিশ করে খেতেন। তার নাম আশরাফুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক ছাত্র, যিনি এখন নিজেই একটি স্যোশাল ইমপ্যাক্ট সংস্থা চালান এবং দেশের পিছিয়ে পড়া তরুণদের ভবিষ্যৎ গড়ার সহায়ক।
ছোটবেলার সংগ্রাম
কুষ্টিয়ার একটি অজপাড়া গাঁয়ে জন্ম আশরাফুলের। বাবা ছিলেন দিনমজুর। মা মারা যান যখন তার বয়স মাত্র ৫। খাবার জোটানোই ছিল সবচেয়ে বড় যুদ্ধ।
প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হলেও, বই কেনার টাকা না থাকায় তাকে পড়াশোনা বন্ধ করে জুতা পালিশ করতে হয়। অনেক সময় রেলস্টেশনে ঘুমিয়েছেন, বাসে কন্ডাক্টরদের অনুরোধ করে রাত কাটিয়েছেন।
কিন্তু মনের ভেতর একটা কথা সবসময় ঘুরতো—
“আমি যদি পড়তে পারতাম, তাহলে হয়তো জীবনটা অন্যরকম হতো।”
স্কুলে ফেরা—নিজের চেষ্টায়
১২ বছর বয়সে আশরাফুল ঢাকায় চলে আসেন। কারওরান বাজার এলাকায় গ্যারেজে কাজ নেন। কাজ শেষে রাতে রাস্তার পাশে ছোট এক ‘ফ্রি স্কুল’-এ যেতেন।
সেখান থেকেই তার জীবনে আসে বড় টার্নিং পয়েন্ট।
একজন স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক তাকে বলেন:
“তুমি যদি সত্যি পড়তে চাও, আমি সাহায্য করবো।”
আশরাফুল দিনে কাজ আর রাতে পড়াশোনা শুরু করেন। জিপিএ ৫ নিয়ে এসএসসি পাশ করেন, তারপর এইচএসসি। শেষ পর্যন্ত ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে।
“Street to University” — নিজের গড়া উদ্যোগ
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই আশরাফুল লক্ষ্য করলেন—এমন শত শত পথশিশু আছে, যাদের জীবন একইভাবে থেমে আছে, শুধু একটা সুযোগ না পাওয়ার কারণে।
তিনি শুরু করলেন “Street to University” নামের একটি উদ্যোগ। তাদের লক্ষ্য—
- পথশিশুদের পড়াশোনায় ফেরানো
- খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা
- শিক্ষামূলক ও নেতৃত্বমূলক স্কিল ডেভেলপমেন্ট
আজ পর্যন্ত এই প্রকল্পে প্রায় ১২০০+ শিশু/কিশোর শিক্ষা ও পুনর্বাসনের আওতায় এসেছে।
স্বীকৃতি ও সম্মান
আশরাফুল ইসলাম আজ শুধু একজন সমাজকর্মী নন, বরং তরুণ নেতৃত্বের প্রতীক। তিনি পেয়েছেন:
- Joy Bangla Youth Award
- UNDP Youth Icon Recognition
- Bijoy Dibosh Padak (Ministry of Social Welfare)
তিনি TEDx, ইউনিভার্সিটি সেমিনার, ও আন্তর্জাতিক ইয়ুথ কনফারেন্সগুলোতে নিয়মিত বক্তা হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।
তার গল্প থেকে কী শিখবো?
১. “অসম্ভব” শব্দটা দারিদ্র্য দেয় না—আমরা দিই
অনেকেই মনে করেন, গরীব পরিবার মানেই স্বপ্ন দেখা যাবে না। আশরাফুল প্রমাণ করেছেন—স্বপ্ন দেখা ফ্রি, শুধু সাহস আর কৌশল দরকার।
২. কেউ যদি হাত না বাড়ায়, আপনি নিজেই হাত বাড়ান
তিনি যখন রাস্তায় ছিলেন, কেউ তাকে হাত বাড়িয়ে দেয়নি। তাই নিজেই নিজের জন্য রাস্তা বানিয়েছেন।
৩. শিক্ষা বদলে দিতে পারে সবকিছু
বই আর কলমের শক্তি কতটা বড়, আশরাফুলের জীবনই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
৪. ‘সাহায্য’ মানে কেবল টাকা নয়
একটি কথা, একটি সময়, একটি খাতা—কারও জীবন বদলে দিতে পারে।
আশরাফুল যা বলেন
“আমি যখন ছোট ছিলাম, সবাই বলতো—এই ছেলে কিচ্ছু হতে পারবে না। আজ সেই কথাগুলোই আমার শক্তি।”
আপনি যদি কখনো নিজেকে নিয়ে সন্দেহে থাকেন, যদি ভাবেন—“আমার জীবন তো শুরুটাই খারাপ ছিল”—তাহলে আশরাফুলের কথা মনে রাখুন।
শুরুর কোনো মানে নেই, যদি আপনি শেষটা বদলে ফেলতে পারেন।