অফিসে দুপুরের খাবার শেষ। পেট ভরেছে ভাত, মাছ আর আলুভর্তা দিয়ে। এবার ডেস্কে ফিরে কাজ শুরু করবেন। কিন্তু কী যেন হচ্ছে! চোখের পাতা ভারী লাগছে। কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন, কিন্তু কিছুই মাথায় ঢুকছে না। একটু যদি মাথা রেখে ৫ মিনিট ঘুমিয়ে নিতে পারতেন! বস কাছে দাঁড়িয়ে আছেন, তাই জোর করে চোখ খোলা রাখছেন। এই অবস্থা কি শুধু আপনার?
একদম না। এটা এতটাই সাধারণ যে বিজ্ঞানীরা এর একটা বিশেষ নাম দিয়েছেন—”পোস্টপ্র্যান্ডিয়াল সমনোলেন্স” বা সহজ ভাষায় “ফুড কোমা”। জি হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন—খাবারের পর যে ঘুম ঘুম ভাব আসে, সেটা একটা স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া।
কিন্তু কেন হয়? রক্ত মস্তিষ্ক থেকে পেটে চলে যায় বলে? সেটা আসলে একটা মিথ! আসল কারণ অনেক বেশি জটিল এবং চমকপ্রদ। এবং আরও ভালো খবর—এটা প্রতিরোধ করা সম্ভব! আসুন জেনে নিই কেন দুপুরের খাবারের পর আপনার মাথা ঝিমঝিম করে, এবং কীভাবে সারাদিন এনার্জেটিক থাকবেন।
কেন দুপুরে খাওয়ার পর ক্লান্তি ধরে?
১) রক্তে শর্করার ওঠা–নামা (Blood Sugar Spike & Crash)
আমরা দুপুরে সাধারণত ভাত, ডাল, মাছ/মাংস, ভর্তা—অর্থাৎ কার্বোহাইড্রেট-সমৃদ্ধ খাবার খাই। ভাত খুব দ্রুত গ্লুকোজে ভেঙে রক্তে চলে যায়। ফলাফল? রক্তে শর্করা হঠাৎ বাড়ে, ইনসুলিন দ্রুত সেটা কমাতে চায়, শর্করা আবার হঠাৎ কমে যায়। এই দ্রুত ওঠানামা শরীরের এনার্জি ব্যালেন্স নষ্ট করে—চোখ ভারী লাগে, মাথা ঘোরে, ঘুম পায়।
২) ডাইজেশনে রক্ত প্রবাহ বেড়ে যায়
খাবার হজম করতে পেট ও অন্ত্রে রক্ত বেশি লাগে। তখন শরীরের অন্য অংশ—বিশেষ করে মস্তিষ্ক—তুলনামূলক কম রক্ত পায়। এ কারণেই খাওয়ার পর মাথা ঝিম ধরে।
৩) খাদ্য তালিকার গোপন ‘ঘুম-দূত’
কিছু খাবার স্বাভাবিকভাবেই Tryptophan, Serotonin, Melatonin বাড়ায়—যা ঘুম আনতে সাহায্য করে। যেমন:
-
ভাত
-
ডাল
-
মাগুর/রুই মাছ
-
কলা
-
দই
এগুলো খেলে শরীর “ঘুমের সিগন্যাল” পাঠাতে শুরু করে।
৪) অতিরিক্ত খাওয়া (Overeating)
আপনার প্লেটে ভাত একটু বেশি হলে খাবারটা সুস্বাদু লাগে সত্যি, কিন্তু শরীরের জন্য সেটা বাড়তি বোঝা। বেশি খেলে শরীর আরো বেশি এনার্জি হজমে ব্যয় করে—ফলে ক্লান্তি বাড়ে।
৫) ঘুম কম হওয়া + ডেস্কে বসে থাকা
বাংলাদেশে বেশিরভাগ মানুষ রাত ১২টার পরে ঘুমায়, সকালে আবার তাড়াতাড়ি উঠে।
দিনে ঘুম কম হলে দুপুরেও শরীর রিপেয়ার নিতে চায়। তার উপর— অফিস/ক্লাসে সারাদিন চেয়ারেই বসে থাকা, একদম নড়া-চড়া না করা, চোখ স্ক্রিনে আটকে রাখা। এগুলো দুপুরের ক্লান্তি আরও বাড়িয়ে দেয়।
কীভাবে দুপুর পরের এনার্জি ধরে রাখবেন?
এগুলো কোনো কঠিন সমাধান না—একটু সচেতন হলেই আপনার দুপুরটা স্মুথ হয়ে যাবে।
১) প্লেটের কার্ব কমান, প্রোটিন বাড়ান
বাংলাদেশি প্লেটে কার্বোহাইড্রেট বেশি থাকে।
একটা সহজ রুল—
- প্লেটের ৪০% ভাত
- ৩০% সবজি
- ৩০% মাছ/মাংস/ডিম
এতে শর্করা ধীরে হজম হবে, এনার্জি স্থির থাকবে।
দুপুরে ভালো প্রোটিন অপশন
- গ্রিলড চিকেন
- মাছ
- ডিম
- ডাল + সবজি
- ছোলা/লালমসুর সালাদ
২) হেভি তেল-ঝাল এড়িয়ে চলুন
তেলেভাজা, বিরিয়ানি, কাচ্চি—এসব দুপুরে খেলেই ঘুম চলে আসবেই।
কারণ এগুলো হজম হতে সময় লাগে, শরীর ক্লান্ত হয়।
যদি অফিসে বিরিয়ানি ডে হয়, চেষ্টা করুন—
- ভাত কম
- মাংস/সালাদ বেশি
- পানি বেশি
৩) ২০ মিনিটের “ওয়াক থেরাপি” কাজ করে ম্যাজিকের মতো
খাওয়ার পর ১৫–২০ মিনিট হাঁটা রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ বাড়ায়।
চেষ্টা করুন—
- অফিসের করিডরে হাঁটুন
- সিঁড়ি দিয়ে কয়েকবার ওঠানামা
- বাইরে সামান্য রোদে দাঁড়ান
বিশেষভাবে IT/desk-job করা মানুষের জন্য এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
৪) পানি খান, ডিহাইড্রেশন সমস্যা কমান
আমাদের দেশের আবহাওয়া গরম, ঘাম বেশি হয়।
ডিহাইড্রেশন = ক্লান্তি + মাথা ব্যথা + ঘুম
খাওয়ার আগে ১ গ্লাস পানি, খাওয়ার পরে ১ গ্লাস পানি—এই দুইটাই যথেষ্ট।
৫) চিনি-সমৃদ্ধ পানীয় বাদ দিন
অনেকে ভাবে সোডা/লাচ্ছি/আইসক্রীম এনার্জি দেবে।
আসলে এগুলো—
রক্তে শর্করা দ্রুত বাড়ায়, এরপর দ্রুত নামায়, ফলে আরো বেশি ক্লান্তি তৈরি করে
তার বদলে— লেবু পানি, নারকেল পানি, কম চিনি দিয়ে লাচ্ছি, গ্রিন টি, খেতে পারেন।
৬) কার্ব সাইক্লিং চেষ্টা করতে পারেন
দিনের সবচেয়ে কম কাজ থাকে দুপুরে—তাই কার্ব-লো রাখলে ভালো।
যেমন:
-
দুপুরে হালকা ভাত + সবজি + প্রোটিন
-
রাতে হালকা রুটি/শাকসবজি
এতে সার্বিক এনার্জিও বাড়বে, ওজনও কমবে।
৭) ৭ ঘণ্টা ঘুম বাধ্যতামূলক
রাতে ৭ ঘণ্টা ঘুম হলে দুপুরে শরীর কম ঘুম পায়।
যাদের ১টা–২টায় ঘুমানোর অভ্যাস— ঘুম ঠিক করুন, মোবাইল বন্ধ রেখে ঘুমান, স্লিপ রুটিন বানান
৮) দুপুরে ‘ফুড কম্বিনেশন’ ঠিক করুন
কিছু খাবার একসাথে খেলে হজম ভালো হয়।
ভাত + ডাল + মাছ
রুটি + সবজি + ডিম
সালাদ + চিকেন
অন্যদিকে—
ভাত + আলুভর্তা + দই
ভাত + চিনি/মিষ্টি
ভাত + কোমল পানীয়
এগুলো হঠাৎ ক্লান্তি বাড়ায়।
৯) Deep breathing (2 minutes)
দুটি নিয়ম—
-
নাক দিয়ে ৪ সেকেন্ড শ্বাস
-
৬ সেকেন্ডে ছাড়ুন
-
এটা ১০ বার করুন
মস্তিষ্কে অক্সিজেন বাড়ে → ক্লান্তি কমে → মনোযোগ বাড়ে।
১০) ‘খাওয়ার গতি’ কমান
অনেকেই দ্রুত খায়। দ্রুত খেলে—
বেশি খাওয়া হয়
হজমে সমস্যা হয়
রক্তে শর্করা দ্রুত বাড়ে
ধীরে ধীরে চিবিয়ে খাওয়াই ভালো।
দুপুরের ক্লান্তি দুর করতে ছোট পরিবর্তনই যথেষ্ট
দুপুরের পর ক্লান্তি হওয়া খুব স্বাভাবিক, কিন্তু এটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়।
একটু সচেতন প্লেট, পানি পানের অভ্যাস, ১৫ মিনিট হাঁটা এবং ঠিকমতো ঘুম—এই চারটি অভ্যাসই আপনাকে দুপুরের সবচেয়ে কঠিন কাজটাও সহজ করে দেবে।
আপনার স্বাস্থ্য আপনার শক্তি—
আর সেই শক্তিটাই আপনাকে বাঁচিয়ে রাখে, প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবনে।

