মনে আছে সেই দিনটার কথা? হয়তো কোনো চাকরির ইন্টারভিউ থেকে বাদ পড়েছেন, ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পাননি, কিংবা নিজের সবটুকু দিয়ে শুরু করা ব্যবসাটা ডুবে গেছে। সেই মুহূর্তে মনে হয়, সব শেষ। পৃথিবীটা এখানেই থেমে গেছে। চারপাশের মানুষগুলোও যেন বলতে শুরু করে, “তোমাকে দিয়ে আর হবে না।”
কিন্তু কী হবে যদি বলি, আপনার এই ব্যর্থতাই হতে পারে আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় জয়ের প্রথম ধাপ? কী হবে যদি বলি, পৃথিবীর সবচেয়ে সফল মানুষগুলোর প্রায় সবাই একসময় আপনার থেকেও বড় ব্যর্থতার শিকার হয়েছিলেন?
আজ আমরা এমন ৫ জন বিশ্বসেরা মানুষের গল্প শুনবো, যাদের পৃথিবীটা একসময় সত্যিই ‘শেষ’ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারা সেই ব্যর্থতাকে ‘ফুল স্টপ’ মনে না করে, একটা ‘কমা’ ভেবেছিলেন। তারা সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে এমন এক বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন, যা আজ ইতিহাস।
১. স্টিভ জবস: নিজের তৈরি কোম্পানি থেকেই যাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল
আমরা স্টিভ জবসকে চিনি অ্যাপলের জিনিয়াস হিসেবে, আইফোন, আইপড আর ম্যাকবুকের রূপকার হিসেবে। কিন্তু ১৯৮৫ সালে, মাত্র ৩০ বছর বয়সে, স্টিভ জবসকে তার নিজের হাতে গড়া কোম্পানি ‘অ্যাপল’ থেকেই অপমানজনকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছিল। যে কোম্পানি তিনি নিজের বাড়ির গ্যারেজে শুরু করেছিলেন, সেই কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টরস মিটিংয়ে তাকে বলা হলো, “অ্যাপলে আপনার আর প্রয়োজন নেই।”
এটা ছিল এক অকল্পনীয় পতন। স্টিভ জবস পরে বলেছিলেন, “আমি জনসমক্ষে এক বিশাল ব্যর্থতার উদাহরণ হয়ে গেলাম। আমি কয়েক মাস দিশেহারা ছিলাম।”
চাকরিচ্যুত হয়ে তিনি ভেঙে পড়তে পারতেন, অবসরে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি ভাবলেন, “আমি যা করতে ভালোবাসি, তা তো এখনো ভালোবাসি।” সেই জেদ থেকে তিনি শুরু করলেন নতুন দুটি কোম্পানি—NeXT (একটি কম্পিউটার কোম্পানি) এবং Pixar (একটি অ্যানিমেশন স্টুডিও)।
Pixar পৃথিবীর প্রথম কম্পিউটার-অ্যানিমেটেড ফিল্ম ‘টয় স্টোরি’ তৈরি করে ইতিহাস গড়ে। অন্যদিকে, অ্যাপল স্টিভ জবসকে ছাড়া প্রায় দেউলিয়া হওয়ার পথে চলে যায়। ১৯৯৭ সালে, অ্যাপল বাধ্য হয়ে NeXT-কে কিনে নেয় এবং স্টিভ জবসকে সিইও হিসেবে ফিরিয়ে আনে। ফিরে এসে তিনি লঞ্চ করেন iMac, iPod, এবং অবশেষে iPhone—যা পৃথিবীটাকেই বদলে দেয়।
ব্যর্থতা মানেই সব শেষ নয়, এটা নতুন এবং আরও ভালো কিছু শুরু করার সুযোগ। স্টিভ জবস যদি সেদিন অ্যাপল থেকে বরখাস্ত না হতেন, তাহলে হয়তো পিক্সার বা আইফোনের জন্মই হতো না।
২. জে. কে. রাউলিং: ১২টি “না” এবং একটি “হ্যাঁ” যা সবকিছু বদলে দিল
১৯৯০ সালের এক ট্রেনে হঠাৎ মাথায় আসে হ্যারি পটারের আইডিয়া। কিন্তু পরের পাঁচ বছর ছিল দুঃস্বপ্নের মতো—মা মারা গেলেন, বিয়ে ভেঙে গেল, একা মা হিসেবে ভাতা নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছিল। এতটাই দরিদ্র ছিলেন যে পাণ্ডুলিপি ফটোকপি করার টাকা ছিল না।
১৯৯৫ সালে পাণ্ডুলিপি শেষ। একের পর এক ১২ জন প্রকাশক প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন: “খুব বড়”, “বাচ্চাদের বই জাদু নিয়ে বিক্রি হয় না।”
কিন্তু ১৯৯৬ সালে ব্লুমসবেরি পাবলিশিং-এর চেয়ারমানের ৮ বছরের মেয়ে প্রথম অধ্যায় পড়ে বলল, “বাকি অংশ কোথায়?” একটা বাচ্চার উৎসাহই যথেষ্ট ছিল।
১৯৯৭ সালে মাত্র ৫০০ কপি দিয়ে শুরু। আজ ৬০ কোটি কপি বিক্রি, ১৫ বিলিয়ন ডলারের ব্র্যান্ড।
প্রত্যাখ্যান মানে শেষ নয়—মানে এখনো সঠিক “হ্যাঁ” পাওয়া হয়নি।
৩. ওয়াল্ট ডিজনি: যাকে “কল্পনাশক্তির অভাব” বলে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল
আজকের দিনে ‘কল্পনাশক্তি’ শব্দটির সাথেই যার নাম আসে, তিনি ওয়াল্ট ডিজনি। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, তরুণ বয়সে ওয়াল্ট ডিজনিকে একটি পত্রিকা অফিস থেকে এই বলেই চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল যে, “তার মধ্যে কোনো কল্পনাশক্তি এবং ভালো আইডিয়ার অভাব রয়েছে।”
এরপর তিনি ‘ল্যাফ-ও-গ্রাম’ নামে নিজের প্রথম অ্যানিমেশন স্টুডিও খোলেন। কিন্তু সেটিও চরমভাবে ব্যর্থ হয় এবং দেউলিয়া হয়ে যায়। ওয়াল্ট ডিজনি এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে, তার কাছে খাবার কেনার মতো টাকাও ছিল না।
সব হারিয়ে তিনি হলিউডে আসেন। তার প্রথম সৃষ্টি ‘অসওয়াল্ড দ্য লাকি র্যাবিট’ চরিত্রটি তার পরিবেশক চুরি করে নেয়। শূন্য হাতে, ওয়াল্ট ডিজনি তার স্টুডিওর এক কোণে বসে একটি ইঁদুরের স্কেচ আঁকেন। নাম দেন ‘মিকি মাউস’। কিন্তু এই মিকি মাউসের আইডিয়াও ৩০০ বারের বেশি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল!
অবশেষে ‘মিকি মাউস’ মুক্তি পায় এবং পৃথিবী বদলে যায়। সেই একটি ইঁদুরের ওপর ভিত্তি করে তিনি গড়ে তোলেন বিনোদনের এক বিশাল সাম্রাজ্য—ডিজনিল্যান্ড, যা আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী জায়গা বলে পরিচিত।
যারা আপনার আইডিয়াকে আজ “বাজে” বলে ছুড়ে ফেলছে, তারাই হয়তো একদিন সেই আইডিয়ার সাফল্যের গল্প করবে। কল্পনাশক্তিকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারে না।
৪. জ্যাক মা: ৩০ বারেরও বেশি প্রত্যাখ্যাত হওয়া মানুষটি
জ্যাক মা-এর ব্যর্থতার তালিকা এতটাই লম্বা যে শুনলে অবাক হতে হয়। তিনি স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় বারবার ফেল করেছেন। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির আবেদন করে ১০ বার প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। যখন চীনে প্রথম কেএফসি (KFC) আসে, তখন তিনি চাকরির জন্য আবেদন করেন। মোট ২৪ জন আবেদনকারীর মধ্যে ২৩ জনের চাকরি হয়, শুধু একজন বাদ পড়েন—তিনি জ্যাক মা।
তিনি পুলিশের চাকরিতে আবেদন করেও প্রত্যাখ্যাত হন। তার প্রথম দুটি ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবসাও মুখ থুবড়ে পড়ে।
১৯৯৫ সালে আমেরিকায় গিয়ে প্রথম ইন্টারনেট দেখার পর তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, এটাই ভবিষ্যৎ। চীনে ফিরে এসে তিনি বন্ধুদের ইন্টারনেটের কথা বললে সবাই তাকে “পাগল” ভাবে। কিন্তু জ্যাক মা হাল ছাড়েননি। তিনি নিজের ছোট অ্যাপার্টমেন্টে ১৭ জন বন্ধুকে নিয়ে শুরু করেন ‘আলিবাবা’।
প্রথম তিন বছর আলিবাবা কোনো লাভ করতে পারেনি। কিন্তু জ্যাক মা তার ভিশনে অটল ছিলেন। আজ আলিবাবা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম। যে মানুষটিকে একটি ফাস্ট ফুড রেস্তোরাঁ চাকরি দেয়নি, সেই মানুষটিই চীনের প্রযুক্তি বিপ্লবের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
ব্যর্থতা আপনার ‘পরিচয়’ নয়, এটা আপনার ‘অভিজ্ঞতা’। কতবার ‘না’ শুনলেন সেটা বড় কথা নয়, আপনার ‘হ্যাঁ’ শোনা পর্যন্ত লেগে থাকাই আসল।
৫. ইলন মাস্ক: তিনটি রকেট বিস্ফোরণ, একটি সাফল্য
২০০৮ সাল। ইলন মাস্কের জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়। টেসলা প্রায় দেউলিয়া, স্পেসএক্সের প্রথম তিনটি রকেট লঞ্চ ব্যর্থ। বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা শেষ।
“আমার কাছে দুটোর জন্য টাকা ছিল না। শেষে দুটোতেই ভাগ করে দিলাম—হয় দুটোই বাঁচবে অথবা দুটোই শেষ,” বলেন মাস্ক।
স্পেসএক্সের প্রথম তিনটি রকেট ব্যর্থ। প্রতিবার লক্ষ লক্ষ ডলার পুড়ে যায়। সবাই বলল ছেড়ে দাও। কিন্তু মাস্কের কাছে আরেকটা—শেষ—চেষ্টার টাকা ছিল।
২০০৮ সালে চতুর্থ লঞ্চ সফল। নাসা স্পেসএক্সকে ১.৬ বিলিয়ন ডলারের কন্ট্রাক্ট দিল।
“যদি চতুর্থ লঞ্চ ব্যর্থ হত, স্পেসএক্স শেষ হয়ে যেত,” স্বীকার করেন মাস্ক।
আজ টেসলা পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান অটো কোম্পানি। স্পেসএক্স পৃথিবীর প্রথম রিইউজেবল রকেট বানিয়েছে।
“যখন কিছু যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, তখন চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়—এমনকি সম্ভাবনা আপনার বিপক্ষে থাকলেও।” —ইলন মাস্ক
স্টিভ জবস, জে. কে. রোলিং, ওয়াল্ট ডিজনি, জ্যাক মা বা ইলন মাস্ক—তাঁদের মধ্যে মিল কী?
তাঁরা কেউ ব্যর্থ হননি তা নয়। মিল হলো, তাঁরা ব্যর্থতাকে ‘শেষ’ হতে দেননি।
তারা সবাই ব্যর্থতাকে একটি ‘ইভেন্ট’ হিসেবে দেখেছেন, ‘পরিচয়’ হিসেবে নয়। তারা ব্যর্থতাকে একটি ‘কমা’ (comma) হিসেবে দেখেছেন, ‘ফুল স্টপ’ (full stop) হিসেবে নয়।
তাই পরেরবার যখন ব্যর্থ হবেন, যখন মনে হবে সব শেষ, যখন চারপাশের মানুষ আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে—এই গল্পগুলো মনে করুন। মনে রাখবেন, প্রতিটি সফল গল্পের পেছনেই এমন অসংখ্য না বলা ব্যর্থতার অধ্যায় থাকে।
আপনার গল্পটাও হয়তো ব্যর্থতা থেকে বিজয়ের পরবর্তী ইতিহাস হওয়ার অপেক্ষায় আছে। শুধু লেগে থাকুন।

