বুধবার, অক্টোবর ২৯, ২০২৫
HomeWellbeingMental Healthজানেন কি, ডিমেনশিয়া আসলে শুরু হয় পা থেকে, মাথা থেকে নয়!

জানেন কি, ডিমেনশিয়া আসলে শুরু হয় পা থেকে, মাথা থেকে নয়!

ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশতা—এই শব্দটি শুনলেই আমাদের চোখে কী ভাসে? ভুলে যাওয়া, সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, কিংবা প্রিয়জনকে চিনতে পারার অক্ষমতা। আমরা সবাই ধরে নিই, এই রোগের শুরুটা হয় মাথা থেকে, আমাদের মস্তিষ্ক থেকে।

কিন্তু যদি বলি, এই ধারণাটি পুরোপুরি সঠিক নয়? যদি বলি, ডিমেনশিয়ার মতো ভয়ঙ্কর একটি রোগের প্রথম সতর্কসংকেত প্রায়শই আমাদের মাথা থেকে নয়, বরং আমাদের ‘পা’ থেকে আসে?

এটি নিছক কোনো চমকপ্রদ তথ্য নয়, এটি আধুনিক নিউরোসায়েন্সের একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এখন ক্রমবর্ধমানভাবে একমত হচ্ছেন যে, স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়ার বহু বছর আগেই, একজন ব্যক্তির হাঁটার ধরণ এবং শারীরিক ভারসাম্যের পরিবর্তন দেখে ডিমেনশিয়ার পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব।

এই তথ্যটি আমাদের সবার জন্য, বিশেষ করে যারা আমাদের প্রবীণ বাবা-মা বা আত্মীয়স্বজনের যত্ন নিই, তাদের জন্য একটি ‘গেম চেঞ্জার’ হতে পারে। চলুন, আজ এই অবিশ্বাস্য সংযোগটির পেছনের বিজ্ঞানকে সহজভাবে জেনে নিই।

ডিমেনশিয়া এবং পায়ের সম্পর্ক: বিজ্ঞান কী বলে?

প্রথমেই বুঝে নেওয়া যাক ডিমেনশিয়া আসলে কী। ডিমেনশিয়া কোনো একক রোগ নয়, বরং বিভিন্ন মস্তিষ্কের রোগের সমষ্টি যা স্মৃতিশক্তি, চিন্তাভাবনা এবং দৈনন্দিন কাজকর্মের ক্ষমতা ক্রমশ কমিয়ে দেয়। আলঝেইমার্স ডিজিজ, লুই বডি ডিমেনশিয়া, ভাস্কুলার ডিমেনশিয়া — এগুলো সবই ডিমেনশিয়ার বিভিন্ন প্রকার।

এখন প্রশ্ন হলো, পায়ের সাথে মস্তিষ্কের সম্পর্ক কী? উত্তরটা আসলে খুবই জটিল এবং চমকপ্রদ। হাঁটা একটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া যা শুধু পেশি এবং হাড়ের কাজ নয়। প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের সমন্বয় প্রয়োজন হয় — ফ্রন্টাল লোব পরিকল্পনা করে, সেরিবেলাম ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে এবং স্পাইনাল কর্ড সিগন্যাল ট্রান্সমিট করে। এমনকি পা থেকে সংবেদনশীল তথ্য মস্তিষ্কে ফিরে যায়।

এই জটিল নেটওয়ার্কের কারণেই হাঁটা আসলে আপনার মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের একটি রিয়েল-টাইম প্রতিফলন। যখন কগনিটিভ ক্ষমতা কমতে শুরু করে, তখন হাঁটার গতি কমে যায়, পদক্ষেপের দৈর্ঘ্য কমে এবং ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। আরও চমকপ্রদ বিষয় হলো, এই পরিবর্তনগুলো প্রায়শই স্মৃতিশক্তি হারানোর লক্ষণ প্রকাশের বহু আগে থেকেই দেখা যায়।

নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায় দেখা গেছে, লুই বডি ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের হাঁটার ধরন আলঝেইমার্স রোগীদের থেকে আলাদা। লুই বডি ডিমেনশিয়ার রোগীরা তাদের পদক্ষেপের সময় এবং দৈর্ঘ্য বেশি পরিবর্তন করেন এবং অসমভাবে চলাফেরা করেন। এর মানে হলো, শুধুমাত্র হাঁটার ধরন দেখেই চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন কোন ধরনের ডিমেনশিয়া হতে পারে।

চারটি সতর্কতা সংকেত যা আপনার জানা উচিত

এখন প্রশ্ন হলো, কী কী লক্ষণ দেখলে সতর্ক হওয়া উচিত? এখানে চারটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত তুলে ধরা হলো।

১. হাঁটার গতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়া

আপনার বাবা বা মা কি আগের চেয়ে অনেক ধীরে হাঁটছেন? ধীর গতিতে হাঁটা এবং কগনিটিভ অভিযোগ একসাথে থাকলে তা “মোটরিক কগনিটিভ রিস্ক সিন্ড্রোম” নির্দেশ করতে পারে, যা স্নায়বিক অবনতির উচ্চ ঝুঁকির ক্লিনিক্যাল বায়োমার্কার হিসেবে কাজ করে।

এটি শুধু বয়সজনিত দুর্বলতা নয়। যদি কেউ সামান্য দূরত্ব অতিক্রম করতে আগের চেয়ে দ্বিগুণ সময় নেন, বারবার থেমে বিশ্রাম নেন বা হাঁটতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন — এটি মস্তিষ্কের এক্সিকিউটিভ ফাংশনে সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি উদাহরণ দিই। ঢাকার মিরপুরে থাকেন ৬৮ বছর বয়সী করিম সাহেব। তিনি প্রতিদিন সকালে পার্কে হাঁটতে যেতেন। কিছুদিন ধরে তার পরিবার লক্ষ করল তিনি একই রুট শেষ করতে আগের চেয়ে ১৫-২০ মিনিট বেশি সময় নিচ্ছেন। প্রথমে সবাই ভাবলো বয়স হয়েছে, স্বাভাবিক। কিন্তু যখন তিনি পরিচিত রাস্তা ভুলে যেতে শুরু করলেন, তখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। পরীক্ষায় ধরা পড়লো মাইল্ড কগনিটিভ ইম্পেয়ারমেন্ট — ডিমেনশিয়ার আর্লি স্টেজ।

২. পা টেনে টেনে হাঁটা এবং ভারসাম্যহীনতা

পা মাটিতে ঘষে ঘষে হাঁটা (স্ক্রাফিং) স্বাভাবিক নয় এবং এটি পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। এর কারণ হতে পারে পারকিনসন্স ডিজিজ অথবা স্নায়ুর ক্ষতিজনিত পায়ের দুর্বলতা বা অসাড়তা।

লক্ষ করুন আপনার প্রিয়জন হাঁটার সময় পা ঠিকমতো তুলতে পারছেন কি না। যদি পায়ের পাতা মেঝেতে ঘষে যায়, সিঁড়িতে হোঁচট খান বা ছোটখাটো বাধায় আটকে যান — এগুলো সব সতর্ক সংকেত।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভারসাম্য। যদি কেউ হাঁটার সময় একদিকে বা দুইদিকে ঝুঁকে পড়েন (লার্চিং), এটি মস্তিষ্কের সেরিবেলামে সমস্যার কারণে হতে পারে। সেরিবেলাম মস্তিষ্কের যে অংশ ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে, ডিমেনশিয়ায় তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

৩. পদক্ষেপের দৈর্ঘ্য এবং প্যাটার্নে অসামঞ্জস্যতা

লুই বডি ডিমেনশিয়ার রোগীদের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো তারা একেক পদক্ষেপে একেক রকম সময় নেন এবং দৈর্ঘ্য পরিবর্তন করেন, যখন আলঝেইমার্স রোগীদের হাঁটার প্যাটার্ন তুলনামূলকভাবে কম পরিবর্তিত হয়।

সহজ ভাষায় বলতে গেলে, যদি কারো হাঁটায় একটা “ছন্দ” না থাকে — কখনো বড় পা, কখনো ছোট পা, কখনো দ্রুত, কখনো ধীর — তাহলে এটি উদ্বেগের কারণ হতে পারে। এই অনিয়মিত প্যাটার্ন পড়ে যাওয়ার ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়।

আরেকটি লক্ষণ হলো পা ঘুরিয়ে সামনে আনা (সার্কামডাকশন)। সার্কামডাকশন হলো সামনের দিকে পা রাখার সময় সোজা না রেখে বৃত্তাকারে নড়ানো, যা পেলভিসের পেশির দুর্বলতা বা হাঁটু ভাঁজ করতে সমস্যার কারণে হতে পারে।

৪. একসাথে দুটো কাজ করতে সমস্যা (ডুয়াল-টাস্কিং)

এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু প্রায়শই উপেক্ষিত লক্ষণ। হাঁটার সময় একসাথে অন্য কাজ করার ক্ষমতা কগনিটিভ ডিক্লাইনের সাথে সাথে কমে যায়। ডুয়াল-টাস্ক বিশ্লেষণ ডিমেনশিয়ার আর্লি ডায়াগনসিসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে না পারেন, হাঁটা থামিয়ে তারপর কথা বলেন, অথবা হাঁটার সময় কোনো সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন — এগুলো সব ইঙ্গিত দেয় যে মস্তিষ্ক একই সময়ে একাধিক কাজ প্রসেস করতে সমস্যায় পড়ছে।

আপনি নিজেই একটি সহজ টেস্ট করতে পারেন। আপনার বাবা বা মাকে হাঁটতে হাঁটতে ১০০ থেকে উল্টো গুনতে বলুন, অথবা কোনো সাধারণ অঙ্ক করতে বলুন। যদি তারা হাঁটা থামিয়ে দেন অথবা হাঁটতে গিয়ে টলমল করেন, তাহলে এটি চিন্তার বিষয়।

কেন হাঁটা এত গুরুত্বপূর্ণ মস্তিষ্কের জন্য?

এখন প্রশ্ন হতে পারে, হাঁটলে কি ডিমেনশিয়া প্রতিরোধ করা যায়? উত্তর হলো — অনেকাংশেই হ্যাঁ। হাঁটা শুধু শরীরের জন্যই নয়, মস্তিষ্কের জন্যও অত্যন্ত উপকারী।

পা নড়াচড়া করলে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়, যা অক্সিজেন এবং গ্লুকোজ সমৃদ্ধ রক্ত মস্তিষ্কের দিকে পাঠায়। উন্নত রক্ত প্রবাহের সাথে মস্তিষ্ক প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় এবং ক্ষতিকর টক্সিন আরও দক্ষতার সাথে পরিষ্কার হয়।

নিয়মিত হাঁটলে BDNF (ব্রেইন-ডিরাইভড নিউরোট্রপিক ফ্যাক্টর) নামক একটি প্রোটিনের মাত্রা বাড়ে। এই প্রোটিন নতুন নিউরন তৈরি এবং বিদ্যমান নিউরনের সুরক্ষায় সহায়তা করে। সহজ ভাষায়, হাঁটা মস্তিষ্কের জন্য একধরনের সার বা খাবার হিসেবে কাজ করে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পায়ের পেশির শক্তি। বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে পায়ের পেশির শক্তি মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের একটি নীরব মার্কার হিসেবে উঠে আসছে। নিম্ন অঙ্গের শক্তি স্বাধীনতা এবং গতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে, কিন্তু এটি কগনিটিভ ডিক্লাইনের ঝুঁকি কমাতেও ভূমিকা পালন করে।

এর মানে হলো, আপনি যদি নিয়মিত হাঁটেন, সিঁড়ি ব্যবহার করেন, ব্যালেন্স এক্সারসাইজ করেন — তাহলে শুধু শরীর নয়, মস্তিষ্কও সুস্থ থাকে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষ চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে ডিমেনশিয়া নিয়ে সচেতনতা খুবই কম। অনেক পরিবারই বয়স্ক মানুষের স্মৃতিশক্তি কমা বা হাঁটতে সমস্যা হওয়াকে “বয়সের দোষ” বলে মেনে নেয়। কিন্তু আসলে এগুলো চিকিৎসাযোগ্য বা অন্তত নিয়ন্ত্রণযোগ্য সমস্যা হতে পারে।

আরেকটি সমস্যা হলো, আমাদের দেশে বয়স্কদের জন্য পর্যাপ্ত হাঁটার জায়গা নেই। ঢাকা শহরে ফুটপাথ ভাঙা, রাস্তাঘাট অসমতল, পার্ক কম। ফলে অনেক বয়স্ক মানুষ বাসায় বসে থাকেন, যা তাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য দুটোই খারাপ করে।

পরিবারের সদস্যদের উচিত বয়স্ক মানুষদের হাঁটার জন্য উৎসাহিত করা। এটি হতে পারে বাসার ছাদে, বাগানে বা কাছাকাছি কোনো নিরাপদ জায়গায়। এমনকি বাসার ভেতরেও নিয়মিত হাঁটাচলা করা উপকারী।

কখন ডাক্তার দেখাবেন?

যদি আপনি বা আপনার প্রিয়জনের মধ্যে উপরে উল্লেখিত লক্ষণগুলোর কোনোটি দেখেন, দ্রুত একজন নিউরোলজিস্ট বা জেরিয়াট্রিশিয়ানের (বয়স্ক চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ) সাথে পরামর্শ করুন। আর্লি ডায়াগনসিস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

গেইট ডিস্টার্বেন্স (হাঁটার সমস্যা) সহ বয়স্ক রোগীদের পাঁচ বছরের ফলো-আপে মৃত্যু বা প্রাতিষ্ঠানিককরণের ঝুঁকি দ্বিগুণেরও বেশি ছিল। অর্থাৎ, এই সমস্যাগুলো উপেক্ষা করলে পরিণতি মারাত্মক হতে পারে।

ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউরোসায়েন্সেস, এবং বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে নিউরোলজি বিভাগ রয়েছে যেখানে আপনি চিকিৎসা নিতে পারবেন।

ডাক্তার সাধারণত বিভিন্ন পরীক্ষা করবেন। এর মধ্যে থাকতে পারে কগনিটিভ টেস্ট (স্মৃতি এবং চিন্তার পরীক্ষা), গেইট অ্যানালাইসিস (হাঁটার বিশ্লেষণ), ব্রেইন ইমেজিং (MRI বা CT স্ক্যান), এবং রক্ত পরীক্ষা। এসব পরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক ডায়াগনসিস করা সম্ভব এবং উপযুক্ত চিকিৎসা শুরু করা যায়।

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা: এখনই শুরু করুন

ডিমেনশিয়া প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো নিয়মিত শারীরিক এবং মানসিক ব্যায়াম। এখানে কিছু ব্যবহারিক টিপস দেওয়া হলো।

নিয়মিত হাঁটুন: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার চেষ্টা করুন। এটি দ্রুত হাঁটা হতে হবে এমন নয়, আরামদায়ক গতিতেই যথেষ্ট। যদি একবারে ৩০ মিনিট সম্ভব না হয়, তাহলে ১০ মিনিট করে তিনবার হাঁটুন।

ডুয়াল-টাস্ক প্র্যাকটিস করুন: হাঁটার সময় কথা বলুন, গান গাইুন বা মনে মনে অঙ্ক কষুন। এটি মস্তিষ্কের একাধিক অংশ একসাথে ব্যবহারে সাহায্য করে। ডুয়াল-টাস্ক ওয়াকিং (হাঁটার সময় পাজল সমাধান বা কথা বলা) মস্তিষ্ক এবং শরীরকে একসাথে কাজ করতে বাধ্য করে, যা কগনিটিভ মাল্টিটাস্কিংয়ের জন্য একটি টিউন-আপের মতো।

ব্যালেন্স এক্সারসাইজ করুন: একপায়ে দাঁড়ানো, হিল-টু-টো ওয়াকিং (এক পায়ের গোড়ালি অন্য পায়ের পাতার সামনে রেখে হাঁটা), এবং সাধারণ তাই চি মুভমেন্ট ভারসাম্য উন্নত করে এবং পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমায়।

পায়ের শক্তি বাড়ান: চেয়ার থেকে উঠা-বসা, স্কোয়াট (আংশিক), এবং পায়ের পাতা উপরে তোলা (টো রাইজ) — এই সহজ ব্যায়ামগুলো বাসাতেই করা যায় এবং পায়ের পেশি শক্তিশালী রাখে।

মানসিক ব্যায়াম করুন: শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ব্যায়ামও জরুরি। বই পড়ুন, ধাঁধা সমাধান করুন, নতুন কিছু শিখুন, পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে কথা বলুন। সামাজিক মিথস্ক্রিয়া মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে এবং ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমায়।

স্বাস্থ্যকর খাবার খান: ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (মাছ), অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (শাকসবজি, ফল), এবং পর্যাপ্ত পানি মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। মিডিটেরেনিয়ান ডায়েট (শাকসবজি, মাছ, অলিভ অয়েল সমৃদ্ধ) ডিমেনশিয়া প্রতিরোধে কার্যকর বলে প্রমাণিত।

নিয়মিত চেকআপ করান: ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, এবং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখুন। এই রোগগুলো ভাস্কুলার ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসরণ করুন।

পরিবারের ভূমিকা: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাপোর্ট সিস্টেম

বাংলাদেশে পরিবারের বন্ধন খুবই শক্তিশালী এবং বয়স্ক মানুষদের যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব পরিবারের ওপরই থাকে। এই সংস্কৃতি আসলে ডিমেনশিয়া প্রতিরোধ এবং ব্যবস্থাপনায় খুবই সহায়ক হতে পারে।

পরিবারের সদস্যদের উচিত বয়স্ক মানুষদের দৈনন্দিন কার্যকলাপে লক্ষ রাখা। হাঁটার ধরনে কোনো পরিবর্তন, স্মৃতিশক্তি কমা, মেজাজের পরিবর্তন — এসব লক্ষণ দেখলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আর্লি ডিটেকশন রোগের অগ্রগতি ধীর করতে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করে।

বয়স্ক মানুষদের নিয়মিত শারীরিক এবং সামাজিক কার্যক্রমে যুক্ত রাখুন। তাদের সাথে হাঁটতে যান, গল্প করুন, তাদের মতামত নিন। একাকীত্ব এবং বিষণ্নতা ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়, তাই পারিবারিক বন্ধন বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।

যদি পরিবারের কেউ ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হন, ধৈর্য ধরুন এবং সহানুভূতিশীল থাকুন। মনে রাখবেন, এটি তাদের দোষ নয় — এটি একটি রোগ। তাদের মর্যাদা বজায় রেখে যত্ন নিন এবং নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করুন।

চিকিৎসার সম্ভাবনা: আশা হারাবেন না

অনেকে মনে করেন ডিমেনশিয়ার কোনো চিকিৎসা নেই। এটি আংশিক সত্য — ডিমেনশিয়া সম্পূর্ণ নিরাময় করা এখনো সম্ভব নয়, কিন্তু রোগের অগ্রগতি ধীর করা এবং উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ আছে যা স্মৃতিশক্তি এবং কগনিটিভ ফাংশন উন্নত করতে সাহায্য করে। থেরাপি এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনও খুবই কার্যকরী। ফিজিওথেরাপি এবং অকুপেশনাল থেরাপি হাঁটার সমস্যা এবং দৈনন্দিন কাজে স্বাধীনতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

গবেষণা দ্রুত এগিয়ে চলেছে। নতুন নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি এবং ওষুধ আবিষ্কৃত হচ্ছে। আর্লি ডায়াগনসিস হলে রোগীরা এই নতুন চিকিৎসা থেকে বেশি উপকৃত হতে পারেন।

ডিমেনশিয়া শুরু হয় পা থেকে — এই বৈজ্ঞানিক সত্যটি আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়। আমরা যদি বয়স্ক মানুষদের হাঁটার ধরনে সামান্য পরিবর্তনও লক্ষ করি এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিই, তাহলে ডিমেনশিয়া প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

মনে রাখবেন, প্রতিটি পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ — আক্ষরিক অর্থেই। আপনার বা আপনার প্রিয়জনের হাঁটার ধরন আসলে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের একটি উইন্ডো। এই উইন্ডো দিয়ে তাকিয়ে আমরা অনেক কিছু বুঝতে পারি এবং সময়মতো ব্যবস্থা নিতে পারি।

আজ থেকেই শুরু করুন। নিয়মিত হাঁটুন, পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের প্রতি সজাগ থাকুন এবং কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। প্রতিরোধ সবসময় চিকিৎসার চেয়ে ভালো — এবং এক্ষেত্রে প্রতিরোধ শুরু হয় আপনার পায়ের যত্ন থেকে, মাথা নয়।

আপনার পা হলো আপনার মস্তিষ্কের দূত। তাদের বার্তা শুনুন, সাড়া দিন এবং সুস্থ থাকুন। কারণ একটি সুস্থ মস্তিষ্ক মানে একটি পূর্ণ এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবন — যা আমরা সবাই আমাদের প্রিয়জনদের জন্য চাই।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular