“সব ঠিক আছে”—এই ছোট্ট কথাটার আড়ালেই লুকিয়ে থাকে হাজারটা না-বলা কষ্ট।
তানজিনা, ২৬ বছরের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। ফেসবুকে সবসময় হাসিমুখের ছবি, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, ভালো রেজাল্ট—সবই ঠিক। কিন্তু রাতের বেলা যখন সে একা থাকে, নিজের মনকে প্রশ্ন করে—“আমি আসলেই ঠিক আছি তো?”
এই প্রশ্নটা আজ আমাদের সবার ভেতরেই কখনো না কখনো উঠে আসে।
চাকরি, পরিবার, পরীক্ষা, সম্পর্ক—সব কিছু সামলে চলতে গিয়ে কখন যে ভেতরে জমে যেতে থাকে রাগ, অভিমান, অপরাধবোধ, হীনমন্যতা, হতাশা—আমরাই বুঝি না। দিনের পর দিন এই নেগেটিভ ইমোশন গুলো আমাদের মন, শরীর, এমনকি জীবনের দিকটাই পাল্টে দেয়।
তাই একে শুধু “মুড অফ” বা “খারাপ সময়” বললেই চলবে না—এই নেগেটিভ ইমোশন একেকটা নিঃশব্দ ঘাতক (Silent Killer)।
নেগেটিভ ইমোশন কীভাবে হয়ে ওঠে নিঃশব্দ ঘাতক?
আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, দীর্ঘ সময় ধরে চাপা রাগ, দুঃখ, অপরাধবোধ বা ভয় আমাদের শরীরে কোর্টিসল নামের স্ট্রেস হরমোন বাড়িয়ে দেয়। এই কোর্টিসল বেশি হলে কী হয়?
- নিদ্রাহীনতা
- উচ্চ রক্তচাপ
- হজমে সমস্যা
- হৃদরোগের ঝুঁকি
- ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে যাওয়া
কিন্তু ভয়ঙ্কর দিক হলো—এইসব শুরু হয় খুব চুপচাপভাবে। আপনি কাজ করছেন, হাসছেন, বাইরে যাচ্ছেন—সবই চলছে। কিন্তু ভিতরটা একসময় ধ্বসে পড়ে। ঠিক সেভাবেই যেভাবে একটা পুরোনো দালান বাইরে থেকে শক্ত মনে হয়, অথচ ভিতরে ভিতরে ইটগুলো খসে পড়ে।
তাহলে কি নেগেটিভ ইমোশন খারাপ?
না। নেগেটিভ ইমোশন আমাদের জীবনের অংশ। ভয় না থাকলে আমরা সাবধান হতাম না। দুঃখ না থাকলে ভালোবাসার গুরুত্ব বুঝতাম না। রাগ না থাকলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতাম না। কিন্তু সমস্যা হয় যখন আমরা এগুলোকে চেপে রাখি, বা ভুলভাবে প্রকাশ করি। তাই দরকার, নেগেটিভ ইমোশনকে “দমন” করা নয়—বরং “পরিচিত” হয়ে, “প্রসেস” করে ইতিবাচকভাবে সামলে নেওয়া।
কীভাবে নিজেকে ঠিক রাখবেন?—৭টি বাস্তব উপায়
১. নিজের অনুভূতিকে স্বীকার করুন
প্রথমেই নিজের সঙ্গে সত্য হোন। “আমি এখন কষ্ট পাচ্ছি”, “আমার ভয় লাগছে”—এই স্বীকারোক্তি আপনাকে হালকা করে দেয়।
- “সব ঠিক আছে” বলার বদলে
- “আমি এখন ভালো নেই, কিন্তু ভালো হতে চাই”—এই মনোভাব গড়ে তুলুন।
২. নেগেটিভ ইমোশনকে লিখে ফেলুন
একটি ডায়েরি বা মোবাইল নোটে দিন শেষে নিজের অনুভূতি লিখে ফেলুন। যেমন: “আজ রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় আমার মন খারাপ। কিন্তু এটা আমার পুরো ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে না।” গবেষণায় দেখা গেছে, লেখা আমাদের ব্রেনের ‘ইমোশন প্রসেসিং’ ক্ষমতা বাড়ায়।
৩. শরীরকে না ভুলে যান
আমরা প্রায়ই মন খারাপ হলে খাওয়া কমিয়ে দিই, বা বিছানায় পরে থাকি।
→ কিন্তু হাঁটা, হালকা ব্যায়াম, পানি খাওয়া—এইসবই শরীরে ডোপামিন বাড়ায়, যা ‘ভালো লাগার হরমোন’। এতে আপনার মনও ধীরে ধীরে শান্ত হয়। একটি গবেষণায় বলা হয়, মাত্র ২০ মিনিট হাঁটা মুড ভালো করতে পারে ৫০% পর্যন্ত।
৪. পছন্দের কিছু করুন—‘মাইন্ড ব্রেক’ নিন
নেগেটিভ চিন্তার মধ্যে পড়ে থাকলে মন আরও ভারী হয়। নিজেকে বের করুন এই লুপ থেকে:
- প্রিয় গান শুনুন
- কিছু পৃষ্ঠা পড়ুন
- বারান্দায় বসে প্রকৃতি দেখুন
- আঁকুন, লিখুন, গাছের যত্ন নিন
একেকটা মাইন্ডফুল কাজ আপনার মস্তিষ্কে পজিটিভ রাসায়নিক বাড়িয়ে দেয়।
৫. কারও সঙ্গে খোলামেলা কথা বলুন
বন্ধু, ভাইবোন, বাবা-মা, কাউন্সেলর—যে হোক, যাকে আপনি বিশ্বাস করেন। মনের কথাগুলো প্রকাশ করলে সেটা আপনার মনে বোঝার মানুষ তৈরি করে। আপনার বলতে না পারার বোঝাটা ভাগ হয়।
৬. সোশ্যাল মিডিয়ার তুলনামূলক জীবন থেকে বিরতি নিন
“ওর জীবন পারফেক্ট, আমার জীবন এলোমেলো”—এই চিন্তা থেকে নিজেকে সরান। সোশ্যাল মিডিয়ায় যা দেখছেন, তার অনেকটাই সাজানো। নিজের বাস্তব জীবনকেই গুরুত্ব দিন। নিজের অগ্রগতি নিজেই নির্ধারণ করুন।
৭. পেশাদার সহায়তা নিন (দোষ নয়, বুদ্ধিমত্তা)
যদি মনে হয় আপনি আর নিজে পারছেন না, মনোবিজ্ঞানী বা থেরাপিস্টের সাহায্য নিন। বাংলাদেশেও এখন অনেক অনলাইন কাউন্সেলিং সেবা রয়েছে (Moner Bondhu, MindTale ইত্যাদি)।
নিজেকে ভালোবাসুন, ভেতর থেকে
নেগেটিভ ইমোশন আমাদের শত্রু না—এটা শুধু ইশারা দেয়, “তোমার ভেতরে কিছু ব্যথা আছে, একটু খেয়াল রাখো।” যদি সেই খেয়ালটা রাখি, তাহলে এই ইমোশনই আমাদের বদলাতে পারে। আপনি ঠিক আছেন কিনা—এই প্রশ্নটা অন্য কেউ জিজ্ঞেস না করুক, আপনি নিজেই করুন।
প্রতিদিন ৫ মিনিট সময় দিন নিজের জন্য। কথা বলুন নিজের সঙ্গে। লিখে ফেলুন মন খারাপের কারণ। হাঁটুন। গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিন। জানেন তো—এই ছোট ছোট কাজগুলো একসময় আপনাকে ফিরিয়ে দেবে বড় একটা শান্তি।
নিজেকে ভালোবাসা মানে সবসময় হাসিখুশি থাকা নয়, বরং নিজের কষ্ট বুঝে—তাকে কোলে নেওয়া, যত্ন নেওয়া। আপনি যদি আজ একটু ঠিক থাকেন, আগামীকাল অনেক ভালো থাকবেন।