“মা শুধু রান্না করতে জানে”—এই বাক্যটা আমার ছেলেকে শুনতে হয়নি। কারণ আমি রান্নাঘর থেকে শুরু করে আজ অনলাইন ব্যবসার মালিক।”
বলছিলেন নারগিস সুলতানা, নারায়ণগঞ্জের এক গৃহবধূ, যিনি এখন একজন সফল উদ্যোক্তা।
নারগিসের গল্পটা অনেকটা সিনেমার মতো—তবে কোনো চমৎকারি মোড় নেই, আছে ধৈর্য, চেষ্টা আর ফেসবুক পেজে পোস্ট করা সেই প্রথম হাতের তৈরি পণ্যের ছবি।
এই লেখায় আমরা জানব, কীভাবে একজন সাধারণ গৃহবধূ শুধুমাত্র নিজের শখ আর ফেসবুক পেজ দিয়ে হয়ে উঠলেন লাখপতি—এবং তার গল্প হয়তো আপনাকেও অনুপ্রাণিত করবে নিজের জার্নি শুরু করতে।
রান্না, বাচ্চা, সংসার আর একটা ছোট স্বপ্ন
নারগিস বিবাহিত, দুই সন্তানের মা। স্বামী একজন প্রাইভেট কোম্পানির কর্মচারী। জীবন চলছিল ঠিকঠাক, কিন্তু নারগিসের মনে হতো, “আমি শুধু সংসার চালিয়ে যেতে চাই না, নিজের পরিচয়ও তৈরি করতে চাই।”
তিনি সবসময় হস্তশিল্প, এমব্রয়ডারি আর বুটিক কাজ পছন্দ করতেন। সময় পেলেই ছেলের পুরনো জামায় ডিজাইন করে ফেলতেন, মেয়ের চুলের ব্যান্ড বানাতেন।
একদিন বানালেন কয়েকটা নকশা করা পুঁতির চুড়ি। মেয়ে সেটা স্কুলে পরে গেলে বন্ধুরা বলল—“তোর মা বানায়? আমাকে একটা বানিয়ে দে না!”
সেদিনই প্রথম বার নারগিস ভাবলেন, “এই কাজটাই আমি সিরিয়াসলি করতে পারি।”
“Nargis’s Hand Touch”
২০১৯ সালে এক আত্মীয়ের সাহায্যে খোলেন নিজের ফেসবুক পেজ—“Nargis’s Hand Touch”। প্রথমে বানালেন ৫ জোড়া হাতের তৈরি চুড়ি, নিজের মোবাইল দিয়েই ছবি তুলে পোস্ট করলেন।
প্রথম এক সপ্তাহে সাড়া তেমন না পেলেও, একদিন এক পরিচিত দুলাভাই একটি সেট অর্ডার করেন। ৭৫০ টাকার সেই অর্ডার ছিল তার অনুপ্রেরণার প্রথম ধাক্কা।
কঠিন ছিল শুরুটা, কিন্তু থেমে যাননি
প্রথমদিকে অনেকেই বলতেন—
“তুমি গৃহবধূ, ঘরে থাকো”
“এইসব অনলাইনে কী হবে?”
“বাচ্চা রেখে পণ্য বানাও, এটা কেমন মা?”
কিন্তু নারগিস জানতেন—আপনি যত ভালো কিছুই করুন, শুরুতে সবাই হাসবে। কিন্তু আপনি যদি হাল না ছাড়েন, একদিন সবাই拍া দেবে।
তিনি দিনে ২ ঘণ্টা কাজ করতেন—বাচ্চারা ঘুমালে বা স্বামী অফিস গেলে। কাঁচামাল কিনতেন সাপ্তাহিক হাট থেকে, পোস্ট করতেন নিয়মিত, আর উত্তর দিতেন আগ্রহীদের ইনবক্সে।
ধীরে ধীরে পেজ বড় হতে থাকে
২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঈদ উপলক্ষে তিনি ৫০ টির বেশি পণ্য বিক্রি করেন। ফেসবুকে তার পেজে তখন ৫ হাজার ফলোয়ার।
“প্রতিটা ইনবক্সের উত্তর নিজে দিতাম। কেউ বললে একটু ডিসকাউন্ট, দিতাম। কেউ কাস্টম ডিজাইন চাইলে রাত জেগে বানাতাম।”
পরে তিনি যুক্ত করলেন:
- এমব্রয়ডারি ওড়না
- হ্যান্ডমেড ব্যাগ
- নকশিকাঁথা ডিজাইন
এগুলো ছিল নারীদের জন্য তৈরি করা অনন্য কিছু—যার প্রতিটা পণ্যে ছিল মায়া আর গল্প।
২০২১ সালের শেষে নারগিস লক্ষ্মীপতি—শুধু অর্থে না, সম্মানেও
বর্তমানে নারগিস প্রতি মাসে গড়ে ৮০,০০০ থেকে ১ লাখ টাকা বিক্রি করেন। তার এখন ৩ জন নারী কর্মী, যারা তার বাসাতেই কাজ করেন।
তিনি এখন:
- স্থানীয় মেলায় অংশ নেন
- “ওমেন অনলাইন উদ্যোক্তা” গ্রুপের সক্রিয় সদস্য
- একটা YouTube চ্যানেল খুলেছেন যেখানে শিখিয়ে দেন হস্তশিল্প
নারগিস বললেন তার ৫টি সফলতার মূলমন্ত্র:
- ঘরের কাজের ফাঁকেও সময় বের করা যায়
→ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১ ঘণ্টাও যথেষ্ট, যদি আপনি ঠিকভাবে পরিকল্পনা করেন। - ফেসবুকের সঠিক ব্যবহার
→ শুধু পোস্ট নয়, ভালো ক্যাপশন, রিভিউ শেয়ার, ছোট ভিডিও—সব মিলিয়ে বিশ্বাস তৈরি হয়। - বাচ্চাদের সময় দেওয়া মানে নিজের স্বপ্ন ভুলে যাওয়া না
→ তিনি সবসময় চেষ্টা করেছেন সন্তানদের সঙ্গে সময় দিতে দিতে নিজের কাজ চালিয়ে যেতে। - নিজের শিক্ষার সীমা থাকলেও শেখার আগ্রহ যেন থাকে
→ ইউটিউব দেখে মার্কেটিং শিখেছেন, Canva দিয়ে পোস্ট বানাতে শিখেছেন। - সমালোচনায় কান না দিয়ে কাজে মন দেওয়া
→ কেউ বললেই থামবেন না। কাজ দিয়ে উত্তর দিন।
আপনার হাতেও হতে পারে লাখপতির জাদু
নারগিসের গল্প শুধুই একটা অনুপ্রেরণা নয়, এটা প্রমাণ—একজন গৃহবধূও চাইলে নিজের পরিচয় গড়তে পারেন, নিজের ঘরেই বসে।
আপনি হয়তো এখনো ভাবছেন, “আমার তো ফোন নেই, টাকা নেই, লোক জানে হাসবে…”
নারগিসও ভেবেছিলেন, কিন্তু শুরু করেছিলেন।
আজ যদি আপনি একটা চুড়ি বানাতে পারেন, আজ যদি আপনি কেক বানিয়ে ছবি দিতে পারেন, তাহলে কাল আপনি নিজেই ব্র্যান্ড হতে পারেন।
শুরুটা ছোট হলেও—সপ্নটা রাখুন বড়।