“শুধু একটু ভাত কম খাচ্ছি, সন্ধ্যায় হেঁটে আসি, তারপরও ওজন বাড়ছে কেন?” — তানিয়ার কণ্ঠে হতাশা স্পষ্ট। ওজন যেন বাড়ছেই, অথচ খাওয়া-দাওয়া বা ব্যায়ামের রুটিনে কোনো ফাঁকি নেই। এমন অভিজ্ঞতা আপনারও হয়েছে? তাহলে সাবধান—আপনার শরীর হয়তো ভিতরে ভিতরে সিগন্যাল দিচ্ছে।
এই অজানা সিগন্যালের পেছনে থাকতে পারে আমাদের শরীরেরই একটি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক—হরমোন। বিশেষত এমন কিছু হরমোন আছে, যা সরাসরি আপনার ওজন বাড়ানো, ক্ষুধা তৈরি এবং চর্বি জমিয়ে রাখার সঙ্গে জড়িত।
হরমোন—ওজন বৃদ্ধির অদৃশ্য নিয়ামক
আমরা প্রায়ই ভাবি ওজন বেড়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ হয়ত বেশি খাওয়া বা কম ব্যায়াম। কিন্তু বিজ্ঞান বলছে—আপনার ওজন অনেকাংশেই নির্ভর করে হরমোনের ভারসাম্যের ওপর।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কিছু নির্দিষ্ট হরমোন ভারসাম্য হারালে তা শরীরে এমনভাবে প্রভাব ফেলে, যেটা শুধুমাত্র ডায়েট বা ব্যায়াম দিয়েই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় না।
কোন হরমোনগুলো দায়ী হতে পারে?
১. কোর্টিসল (Cortisol)
এটি স্ট্রেস হরমোন নামে পরিচিত। যখন আপনি দীর্ঘ সময় স্ট্রেসে থাকেন (যেমন: অফিসের চাপ, সম্পর্কের টানাপড়েন), তখন কোর্টিসল লেভেল বেড়ে যায়।
এর ফল: শরীর বেশি চর্বি জমায়, বিশেষ করে পেটের চারপাশে।
২. ইনসুলিন (Insulin)
রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখে ইনসুলিন। কিন্তু বেশি চিনি বা কার্ব খাওয়ার ফলে ইনসুলিন রেজিস্টেন্স তৈরি হয়।
ফলাফল: শরীর অতিরিক্ত শর্করাকে ফ্যাট হিসেবে জমিয়ে রাখে।
৩. লেপ্টিন ও ঘ্রেলিন (Leptin & Ghrelin)
এই দুই হরমোন আপনার খিদে ও পেট ভরার সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করে। ঘুম কম হলে বা অনিয়মিত জীবনযাপন হলে লেপ্টিন কমে যায়, ঘ্রেলিন বেড়ে যায়—ফলে আপনি অপ্রয়োজনীয় খিদে অনুভব করেন।
৪. থাইরয়েড হরমোন
থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি (হাইপোথাইরয়েডিজম) হলে শরীরের মেটাবলিজম স্লো হয়ে যায়। এতে করে সাধারণ খাবারও সহজে ফ্যাটে রূপান্তরিত হয়।
আপনি কীভাবে বুঝবেন ওজন বাড়ছে হরমোনজনিত কারণে?
- পেট ও কোমরের পাশে অস্বাভাবিক মেদ জমছে
- খাওয়ায় বিশেষ পরিবর্তন না থাকলেও ওজন বাড়ছে
- ঘুমের সমস্যা, মন খারাপ, বারবার খিদে লাগা
- ক্লান্তি, ত্বকে রুক্ষতা, চুল পড়া, মাসিকের অনিয়ম
এমন লক্ষণগুলো থাকলে হরমোনাল ইমব্যালেন্সের সম্ভাবনা বেশি। এমন অবস্থায় শুধু ডায়েট নয়, বরং ডাক্তারের পরামর্শে হরমোন টেস্ট করে নেয়াই ভালো।
সমাধান: ওজন কমাতে হরমোনকে বন্ধু বানান
১. স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণে আনুন
- নিয়মিত মেডিটেশন
- ধীরে শ্বাস নেওয়ার অভ্যাস
- সকালে অন্তত ১০ মিনিট হাঁটাহাঁটি
২. ভালো ঘুম নিশ্চিত করুন
- প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমানো
- রাতে মোবাইল বন্ধ রাখা
- ঘুমানোর আগে ভারী খাবার এড়িয়ে চলা
৩. সুষম ও কম ইনফ্লেমেটরি ডায়েট
- চিনি ও প্রসেসড খাবার কমান
- ফাইবার ও প্রোটিন বাড়ান (ডাল, ডিম, বাদাম)
- বেশি পানি পান করুন
৪. বডি-মুভমেন্ট জরুরি
- সপ্তাহে অন্তত ৪ দিন ৩০ মিনিট করে হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম
- যোগব্যায়াম বা স্ট্রেচিং করলে কোর্টিসল হরমোন কমে
৫. ডাক্তার দেখুন ও প্রয়োজনীয় হরমোন পরীক্ষা করান
- যেমন: TSH, Free T3, Free T4 (থাইরয়েড)
- Insulin, Cortisol, Leptin, Ghrelin লেভেল
ওজন বাড়া মানেই আপনার ব্যর্থতা নয়
আপনার শরীর একটি জটিল কিন্তু বুদ্ধিমান ব্যবস্থা। হরমোন নিয়ন্ত্রণ হারালে, শরীর সেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। তাই নিজেকে দোষ না দিয়ে, নিজের শরীরের ভাষা বোঝার চেষ্টা করুন।
ক্যালোরি কমানো বা ঘন্টার পর ঘন্টা জিমে সময় দিয়ে যদি কিছু না হয়—তাহলে হরমোনই হতে পারে চাবিকাঠি।
আপনার যদি ওজন নিয়ে হঠাৎ সমস্যা হয়ে থাকে, তাহলে আজই একবার হরমোনের দিকটা যাচাই করে দেখুন। হয়তো সেখানেই লুকিয়ে আছে সমাধান।