“আগে যা মনে রাখতাম, এখন গুগল করে দেখি…”
রাস্তায় যাওয়ার আগে মনে রাখতে হতো কোন দিকে মোড় নিতে হবে। কোনো নম্বর, কার জন্মদিন, কোনো ঠিকানা — সব ছিল মাথার মধ্যে।
এখন? সবই ফোনে লেখা।
একটা কল ডায়াল করতেও নাম ছাড়া নম্বর জানার দরকার পড়ে না। এই প্রযুক্তি আমাদের জীবন সহজ করেছে ঠিকই, কিন্তু সহজের এই নেশা কি ধীরে ধীরে আমাদের স্মৃতিশক্তিকেই অলস করে দিচ্ছে? আর এই অলসতা কি একসময় আমাদের ঠেলে দিচ্ছে স্মৃতিভ্রষ্টতা বা ডিমেনশিয়ার দিকে?
চলুন, বিজ্ঞানের আলোয়, বাস্তব অভিজ্ঞতায় এবং আমাদের নিত্য ব্যবহারিক জীবনে খুঁজে দেখি —
প্রযুক্তি কি ডিমেনশিয়া বাড়িয়ে দিচ্ছে?
ডিমেনশিয়া কী?
ডিমেনশিয়া হলো মস্তিষ্কের এক ধরনের অবনতি, যেখানে স্মৃতি, চিন্তা, বিচারক্ষমতা, এমনকি ভাষাও ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে।
সবচেয়ে পরিচিত ধরন:
অ্যালঝেইমার ডিজিজ — যা সাধারণত বয়স্কদের মধ্যে দেখা যায়, তবে এখন তরুণদের মধ্যেও প্রাথমিক উপসর্গ দেখা যাচ্ছে।
প্রযুক্তির প্রভাব: স্মৃতি লোপ পাচ্ছে, না কি আমরা সেটাকে চাপ দিচ্ছি না?
১. ‘ডিজিটাল ডিপেন্ডেন্স’ স্মৃতিকে অলস করে তোলে
আগে আমরা নাম্বার মুখস্থ রাখতাম। এখন ফোনবুক ছাড়া কাউকে ফোনই করতে পারি না। আগে ঠিকানা মনে রাখতে হতো, এখন Google Maps খুলে দেখি। এভাবে প্রযুক্তির ব্যবহারে আমাদের মস্তিষ্কের ‘মেমোরি মাংসপেশি’ আর কাজ করছে না আগের মতো।
গবেষণা বলছে:
যখন আমরা নিয়মিত কোনো জিনিস মনে রাখার চেষ্টা না করি, তখন সেই ‘নিউরাল পাথওয়ে’ দুর্বল হয়ে যায়।
– University College London (UCL) এর এক গবেষণায় বলা হয়: “ডিজিটাল স্মৃতি আমাদের আসল স্মৃতিকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে।”
২. স্ক্রিন টাইম বেশি হলে মনোযোগ দুর্বল হয়
আজকাল একজন মানুষ দিনে গড়ে ৬–৮ ঘণ্টা স্ক্রিনে কাটান। এতক্ষণ মনোযোগ স্ক্রিনে থাকলে মানুষের মস্তিষ্ক বিভক্ত মনোযোগে অভ্যস্ত হয়ে যায় — যেটা “Deep Focus” কে বাধাগ্রস্ত করে।
📌 যখন মনোযোগ কমে, তখন স্মৃতির ধরার ক্ষমতাও কমে যায়।
৩. নতুন তথ্য নিতে নিতে পুরনো তথ্য বাদ পড়ে
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিদিন ১০০+ কনটেন্ট চোখের সামনে ঘোরে। প্রতিদিন কত নাম, খবর, ভিডিও — মস্তিষ্ক কীভাবে সামাল দেবে? মস্তিষ্ক তখন করে “ডাম্পিং” — পুরনো তথ্য বাদ দিয়ে নতুনটায় ফোকাস করে।
ফলাফল:
– নাম মনে থাকে না
– মুখ চেনা হয় কিন্তু পরিচয় মনে আসে না
– পুরনো স্মৃতি ঝাপসা হয়ে যায়
তাহলে কি প্রযুক্তিই দায়ী?
প্রযুক্তি নিজে সমস্যা না — সমস্যা হলো ব্যবহার করার পদ্ধতি ও মাত্রা।
প্রযুক্তি অনেক কিছু শেখায়, সংযুক্ত করে, সংরক্ষণ করে — কিন্তু যখন আপনি সব কিছুই ডিভাইসের উপর ছেড়ে দেন, তখন নিজের মস্তিষ্কের দায়িত্ববোধ হারিয়ে যায়।
ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিশক্তি হ্রাস তখন ধীরে ধীরে বাসা বাঁধে।
গবেষণা বলছে কী?
Journal of Alzheimer’s Disease:
অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম, মনোযোগ হ্রাস ও এক্সারসাইজের অভাব — এই তিনটি প্রযুক্তিনির্ভর জীবনধারা ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
Harvard Medical School:
প্রযুক্তির ব্যবহার যদি সক্রিয় অংশগ্রহণমূলক হয় (যেমন সমস্যা সমাধান, পাজল খেলা), তাহলে মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকে। কিন্তু যদি আপনি ভোক্তা হিসেবে থাকেন (যেমন কেবল স্ক্রল করা), তাহলে মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় হতে শুরু করে।
তাহলে করণীয় কী?
১. প্রযুক্তি হোক সহায়ক, নিয়ন্ত্রণকারী নয়
– নিজেই ফোন নাম্বার মুখস্থ রাখার অভ্যাস করুন
– Google Maps না দেখে মাঝে মাঝে পথ মনে রাখার চেষ্টা করুন
– কাজের ডিটেইল ফোনে না লিখে, হাতে লিখুন — এতে স্মৃতি গেঁথে যায়
২. স্ক্রিন টাইমে ডায়েট রাখুন
– দিনে ১ ঘণ্টা “no-screen” টাইম রাখুন
– ঘুমানোর আগে অন্তত ৩০ মিনিট স্ক্রিন মুক্ত থাকুন
– মনোযোগের একটানা অনুশীলন করুন (যেমন ২০ মিনিট বই পড়া)
৩. স্মৃতি চর্চা করুন
– পুরনো গান মনে করে গুনগুন করুন
– ছোট ছোট গল্প নিজে বানিয়ে মনে রাখার চেষ্টা করুন
– দৈনন্দিন কাজ নিজের মনে বলুন (যেমন: “আজ আমি আম-লেবু কিনব”)
📌 মস্তিষ্ক একধরনের পেশি — যত ব্যবহার করবেন, ততই শক্তিশালী হবে।
প্রযুক্তির হাতে জীবন হালকা হয়েছে, মস্তিষ্কও যেন হালকা হয়ে যাচ্ছে?
প্রযুক্তি আমাদের বন্ধু — কিন্তু সেই বন্ধুর কাঁধে সব দায়িত্ব দিলে, আমরা নিজেরা দায়িত্বশূন্য হয়ে পড়ি।
স্মৃতি, চিন্তা আর অনুভব — এগুলো কেবল ডেটা নয়, এগুলো আমাদের মানুষ হিসেবে আলাদা করে।
ডিমেনশিয়া একটা কঠিন বাস্তবতা — কিন্তু সতর্ক ব্যবহার, সচেতন প্রযুক্তিচর্চা, আর মস্তিষ্কের সক্রিয়তা বজায় রাখলেই আমরা সেটা অনেকটাই ঠেকাতে পারি।
মনে রাখুন:
- প্রযুক্তি আমাদের মস্তিষ্কের জায়গা নিতে পারবে না — যতক্ষণ না আমরা সেটা দিতে রাজি হই
- প্রতিদিন সামান্য কিছু অনুশীলন আপনার স্মৃতি ও স্নায়ুকে দীর্ঘদিন সতেজ রাখতে পারে
- বাঁচার জন্য প্রযুক্তি নয়, চিন্তা করার শক্তিই আমাদের আসল অস্ত্র