বুধবার, অক্টোবর ২২, ২০২৫
HomeWellbeingNutrition৭২ ঘণ্টা উপবাস: ইমিউন সিস্টেম কি সত্যিই 'রিবিল্ড' হয়? বিজ্ঞান কী বলে

৭২ ঘণ্টা উপবাস: ইমিউন সিস্টেম কি সত্যিই ‘রিবিল্ড’ হয়? বিজ্ঞান কী বলে

২০১৪ সালে ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার (USC) ভ্যালটার লঙ্গো টিম দেখায়, বারবার দীর্ঘ উপবাস (প্রলংড ফাস্টিং) ও পুনরায় খাওয়া—এই ‘সাইকেল’ কিছু ক্ষেত্রে ইমিউন সিস্টেমে পরিবর্তন আনে। প্রাণী-মডেল ও কেমোথেরাপি নেওয়া মানুষের ছোট গোষ্ঠীতে দেখা যায় যে দীর্ঘ উপবাসে শ্বেত রক্তকণিকা কমে গিয়ে পুনরায় খাওয়ার সময় রক্ত-গঠনকারী (হেমাটোপোয়েটিক) স্টেম সেল সক্রিয় হয়; এই প্রক্রিয়ায় ইমিউন কোষের “রিজেনারেশন” ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মূল বায়োকেমিক্যাল ব্যাখ্যায় দেখা যায় IGF-1 হরমোন ও PKA সিগন্যালিং কমে, যা স্টেম সেল-স্বনবীকরণকে উৎসাহিত করে। তবে এটা সর্বজনীন “পূর্ণ রিবিল্ড” নয়—বিশেষ কনটেক্সটে, ছোট নমুনায় পাওয়া ফল।

চলুন, বিজ্ঞান কী বলে তা খতিয়ে দেখি। এই ‘রিবিল্ড’ বা পুনর্গঠনের দাবি কি নিছকই ইন্টারনেট গুজব, নাকি এর পেছনে আছে  বৈজ্ঞানিক প্রমাণ?

উপবাসের সময় শরীরে কী ঘটে?

খাবার না খেলে শরীর প্রথমে গ্লুকোজ বা শর্করা থেকে শক্তি নেয়। সাধারণত, ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই শর্করার ভান্ডার শেষ হয়ে যায়। এরপর শরীর চর্বি বা ফ্যাট ভাঙতে শুরু করে। কিন্তু ৭২ ঘণ্টার উপবাস শরীরের সেলুলার স্তরে আরও গভীরে কাজ করে।

১. অটোফ্যাজি (Autophagy): কোষের আত্মশুদ্ধি

উপবাসের ২৪ ঘণ্টা পার হলেই সাধারণত অটোফ্যাজি প্রক্রিয়া শুরু হয়, যা ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত চলতে থাকে। অটোফ্যাজি হলো একটি সেলুলার প্রক্রিয়া, যার অর্থ ‘আত্ম-ভক্ষণ’।

  • সহজ করে বললে: কোষ তখন তার ভেতরকার পুরনো, ক্ষতিগ্রস্ত বা অপ্রয়োজনীয় অংশগুলো, যেমন—ক্ষতিগ্রস্ত প্রোটিন বা কোষীয় অঙ্গাণুগুলোকে খেয়ে ফেলে বা রিসাইকেল করে।
  • সুবিধা: এই প্রক্রিয়াটি কোষকে পরিষ্কার করে এবং নতুন, স্বাস্থ্যকর কোষ তৈরি করতে সহায়তা করে। ৭২ ঘণ্টার উপবাসে অটোফ্যাজি তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।

২. হিউম্যান গ্রোথ হরমোন (HGH) বৃদ্ধি

দীর্ঘ উপবাসের ফলে শরীরে HGH-এর মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এটি একটি বিশেষ হরমোন, যা মাংসপেশি বজায় রাখতে এবং চর্বি পোড়াতে সাহায্য করে।

ইমিউন সিস্টেমের ‘রিবিল্ড’ রহস্য

এই আলোচনার মূল প্রশ্ন হলো—ইমিউন সিস্টেম কি সত্যিই নতুন করে তৈরি হয়? এর উত্তরটা কিছুটা জটিল, তবে বৈজ্ঞানিক তথ্য বেশ ইতিবাচক।

ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি (University of Southern California)-এর অধ্যাপক ভ্যাল্টার লংগোর (Valter Longo) নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণা থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়:

৩. শ্বেত রক্তকণিকার (White Blood Cells) পতন ও পুনর্জন্ম

গবেষণায় দেখা গেছে, ৭২ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় উপবাস করলে শ্বেত রক্তকণিকা (যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মূল উপাদান) উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। এর কারণ হলো—শরীর তখন শক্তি সংরক্ষণের জন্য পুরানো, ক্ষতিগ্রস্ত বা অপ্রয়োজনীয় ইমিউন কোষগুলোকে রিসাইকেল করে।

  • গুরুত্বপূর্ণ ধাপ: এই কমে যাওয়া কোষের সংখ্যাই শরীরের স্টেম সেলকে (Stem Cells) সক্রিয় করে তোলে।
  • পুনর্গঠন (Regeneration): যখন উপবাস ভাঙা হয় এবং শরীর আবার খাবার গ্রহণ শুরু করে (Re-feeding), তখন এই স্টেম সেলগুলো নতুন করে তাজা ও শক্তিশালী শ্বেত রক্তকণিকা তৈরি করা শুরু করে। একেই বিজ্ঞানীরা ইমিউন সিস্টেমের ‘রিবিল্ডিং’ বা পুনর্জন্ম বলছেন। এটি অনেকটা পুরনো জিনিসপত্র ফেলে দিয়ে নতুন ফার্নিচার আনার মতো।

৪. PKA এবং IGF-1 এনজাইমের ভূমিকা

উপবাসের সময় শরীরে দুটি এনজাইম বা হরমোনের মাত্রা কমে যায়:

  • PKA (Protein Kinase A): এই এনজাইমের মাত্রা কমা সরাসরি স্টেম সেলকে নতুন ইমিউন কোষ তৈরি করার জন্য সংকেত দেয়। PKA-কে বার্ধক্যের সাথেও সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়।
  • IGF-1 (Insulin-like Growth Factor 1): এটি একটি গ্রোথ হরমোন, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। উপবাসের সময় এর মাত্রা কমে যাওয়া বার্ধক্যবিরোধী (Anti-aging) প্রভাব ফেলতে পারে।

কারা এই উপবাস থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেতে পারেন?

  • বার্ধক্যজনিত সমস্যা: গবেষণায় দেখা গেছে, উপবাসের এই চক্র বার্ধক্যজনিত দুর্বল ইমিউন সিস্টেমকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।
  • কেমোথেরাপি রোগী: কিছু গবেষণায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, নির্দিষ্ট সময় উপবাস করলে কেমোথেরাপির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে স্বাস্থ্যকর কোষগুলো রক্ষা পেতে পারে, এবং একই সাথে ইমিউন সিস্টেম পুনর্গঠিত হতে পারে। (তবে এটি অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হতে হবে)।

কিন্তু সতর্কতা জরুরি: উপবাসের ঝুঁকি ও গাইডলাইন

৭২ ঘণ্টার উপবাস একটি শক্তিশালী প্রক্রিয়া, কিন্তু এটি সবার জন্য নয় এবং অবশ্যই এটি শুরু করার আগে কিছু বিষয় মাথায় রাখা উচিত।

১. বৈজ্ঞানিক সীমাবদ্ধতা

যদিও ফলাফল আশাব্যঞ্জক, তবে বেশিরভাগ গবেষণা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে বা প্রাণীদেহে (ইঁদুর) হয়েছে। মানবদেহে এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব এবং আদর্শ পদ্ধতি নিয়ে আরও বড় আকারের গবেষণা প্রয়োজন।

২. ঝুঁকি কাদের জন্য?

  • যাদের ডায়াবেটিস আছে এবং ইনসুলিন নিচ্ছেন।
  • গর্ভবতী বা স্তন্যদানকারী নারী।
  • যাদের খাদ্যাভ্যাসজনিত রোগ (Eating Disorder) আছে।
  • যাদের রক্তচাপ খুব কম।

৩. উপবাস কীভাবে ভাঙবেন? (Re-feeding)

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, উপবাসের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো উপবাস ভাঙার সময় কী খাচ্ছেন। উপবাসের পরে হঠাৎ ভারী খাবার খেলে শরীর অসুস্থ হতে পারে।

  • গাইডলাইন: উপবাস ভাঙার সময় হালকা স্যুপ, সামান্য সবজি বা সহজপাচ্য প্রোটিন দিয়ে শুরু করা উচিত। এই ‘রি-ফিডিং’ পিরিয়ডেই নতুন ইমিউন কোষ তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত হয়।

৭২ ঘণ্টা উপবাসের মাধ্যমে ইমিউন সিস্টেমের ‘রিবিল্ড’ হওয়ার ধারণাটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় যথেষ্ট শক্তিশালী ভিত্তি পেয়েছে। এটি কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়, বরং শরীরের স্টেম সেলকে সক্রিয় করে পুরনো ও ক্ষতিগ্রস্ত কোষ সরিয়ে নতুন কোষ তৈরির একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া।

আপনি যদি আপনার জীবনযাত্রায় এই ধরনের দীর্ঘ উপবাস যুক্ত করতে চান, তবে অবশ্যই একজন পুষ্টিবিদ বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। মনে রাখবেন, স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা হলো সঠিক জ্ঞান, অভ্যাস এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের ফসল।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -spot_img

Most Popular